নেতা বা আমির হওয়া এবং নেতারা কেন বেশি জাহান্নাতে যাবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আবু ওয়ায়েল শাকীক ইবনে সালামা (রহঃ) বলেন, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হযরত বিশর ইবনে আসেম (রাঃ)কে হাওয়াযেন গোত্রের যাকাত উসূল করার কাজে নিযুক্ত করিলেন। হযরত বিশর (রাঃ) কাজে গেলেন না। পরবর্তীতে হযরত ওমর (রাঃ)এর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইলে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কেন গেলে না? আমার কথা শুনা ও মানা কি জরুরী নয়? হযরত বিশর (রাঃ) বলিলেন, নিশ্চয় জরুরী। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করিতে শুনিয়াছি যে, যাহাকে মুসলমানদের কোন কাজের দায়িত্ববান (নেতা) বানানো হয় তাহাকে কেয়ামতের দিন আনিয়া জাহান্নামের পুলের উপর দাঁড় করানো হইবে। যদি সে উক্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিয়া থাকে তবে মুক্তি লাভ করিবে। আর যদি সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করিয়া থাকে তবে সেই পুল তাহাকে লইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং সে সত্তর বৎসর পর্যন্ত জাহান্নামের তলদেশে যাইতে থাকিবে।
নেতা বা আমির হওয়া
হযরত ওমর (রাঃ) ইহা শুনিয়া অত্যন্ত পেরেশান ও চিন্তাযুক্ত হইয়া সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন। পথে আবু যার (রাঃ)এর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ব্যাপার? আমি আপনাকে পেরেশান ও চিন্তাযুক্ত দেখিতেছি? হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, আমি কেন পেরেশান ও চিন্তাযুক্ত হইব না? আমি হযরত বিশর ইবনে আসেম (রাঃ) হইতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই এরশাদ শুনিয়াছি বলিয়া, বিস্তারিত বলিলেন। ইহা শুনিয়া হযরত আবু যার (রাঃ) বলিলেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হইতে এই হাদীস শুনিতে পান নাই? হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, না। হযরত আবু যার (রাঃ) বলিলেন, আমি ইহার সাক্ষ্য দিতেছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করিতে শুনিয়াছি যে, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে জিম্মাদার(নেতা) বানাইবে সেই ব্যক্তিকে কেয়ামতের দিন জাহান্নামের পুলের উপর আনিয়া দাঁড় করানো হইবে। যদি সে (জিম্মাদার বা নেতা বানানোর ব্যাপারে সঠিক করিয়া থাকে তবে সে জাহান্নাম হইতে) মুক্তি পাইবে। আর যদি সে সঠিক না করিয়া থাকে। তবে তাহাকে সহ পুল ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং সে সত্তর বৎসর পর্যন্ত জাহান্নামের তলদেশে যাইতে থাকিবে। আর সেই জাহান্নাম কালো ও অন্ধকার হইবে। (এখন আপনি বলুন,) এই দুই হাদীসের মধ্যে কোনটি আপনার অন্তরের জন্য অধিক পীড়াদায়ক? হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, উভয় হাদীস আমার অন্তরকে পীড়া দিতেছে। এইরূপ বিপদজনক দায়িত্ব তবে কে গ্রহণ করিবে? হযরত আবু যার (রাঃ) বলিলেন, আল্লাহ তায়ালা যাহার নাক কর্তন করার ও গাল মাটির সহিত লাগাইবার (অর্থাৎ তাহাকে অপদস্থ করার ইচ্ছা করিয়াছেন সে এই দায়িত্ব গ্রহণ করিবে। তবে আমাদের জানামতে আপনার খেলাফতে কল্যাণই রহিয়াছে। অবশ্য এই সম্ভাবনা রহিয়াছে যে, আপনি হয়ত এমন ব্যক্তিকে এই খেলাফতের দায়িত্ব দিবেন, যে উহাতে ইনসাফ করিবে না, তখন আপনিও উহার গুনাহ হইতে মুক্তি পাইবেন না। (তারগীব)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাঃ)কে এক ঘোড়সওয়ার বাহিনীর আমীর(নেতা) বানাইলেন। তিনি ফিরিয়া আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এই আমীর(নেতা) হওয়াকে কেমন দেখিলে? হযরত মেকদাদ (রাঃ) বলিলেন, আমার এই সঙ্গীরা আমাকে উপরে উঠাইত ও নীচে নামাইত। অর্থাৎ আমার খুবই সম্মান করিত, যদ্দরুন আমার মনে হইতেছে, আমি সেই পূর্বের মেকদাদ রহি নাই। (অর্থাৎ আমার মধ্যে পূর্বের বিনয় স্বভাব রহে নাই।)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, প্রকৃতপক্ষে আমীর(নেতা) হওয়া এমনই জিনিস। হযরত মেকদাদ (রাঃ) বলিলেন, সেই পাক যাতের কসম, যিনি আপনাকে হক দিয়া প্রেরণ করিয়াছেন, আগামীতে আমি আর কখনও কোন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করিব না। সুতরাং পরবর্তীতে লোকেরা তাহাকে বলিত যে, আপনি আগাইয়া আসুন এবং আমাদের নামায পড়াইয়া দিন। কিন্তু তিনি পরিস্কার অস্বীকার করিয়া দিতেন। (কেননা নামাযে ইমামতীও একপ্রকার জিম্মাদারী বা নেতা হওয়া)
তাবারানীর অপর এক রেওয়ায়াতে আছে, এক ব্যক্তি বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে কোন জামাতের আমীর(নেতা) বানাইলেন। যখন কাজ করিয়া ফিরিয়া আসিল তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমীর(নেতা) হওয়াকে কেমন পাইয়াছ? সে বলিল, আমি জামাতেরই একজন সঙ্গীর ন্যায় ছিলাম। যখন আমি আরোহণ করিতাম তখন সঙ্গীগণও আরোহণ করিত, আর যখন আমি সওয়ারী হইতে নামিতাম তখন তাহারাও নামিয়া পড়িত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন,সাধারণতঃ প্রত্যেক সুলতান (ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) এরূপ (জুলুম অত্যাচারমূলক কাজ করে যদ্দরুন সে আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির দ্বারে যাইয়া উপনীত হয়। তবে যে সুলতানকে বা নেতাকে আল্লাহ তায়ালা নিজ হেফাজতে লইয়া লন সে বাঁচিয়া যায়। (বরং এরূপ সুলতান বা নেতা তো আল্লাহ তায়ালার আরশের ছায়ালাভ করিবে।) উক্ত ব্যক্তি বলিল, আল্লাহর কসম, আজ হইতে আমি না আপনার পক্ষ হইতে, আর না অন্য কাহারো পক্ষ হইতে আমীর হইব। ইহা শুনিয়া নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে হাসিয়া উঠিলেন যে, তাঁহার দাঁত মোবারক দেখা যাইতে লাগিল।
আমীর(নেতা) হওয়ার ব্যাপারে হযরত আবু বকর (রাঃ)এর অসিয়ত
হযরত রাফে’তায়ী (রাঃ) বলেন, আমি হযরত আবু বকর (রাঃ)এর সহিত এক জেহাদের সফরে ছিলাম। আমরা যখন ফিরিয়া আসিতে লাগিলাম তখন আমি বলিলাম, হে আবু বকর ! আমাকে কিছু নসীহত করুন। তিনি বলিলেন, ফরজ নামাযকে সময়মত আদায় করিবে, নিজের মালের যাকাত খুশীমনে আদায় করিবে। রমযানে রোযা রাখিবে, বাইতুল্লাহ শরীফের হজ্জ করিবে। আর এই বিশ্বাস রাখিবে যে, হিজরত করা ইসলামের মধ্যে অত্যন্ত উত্তম আমল আর হিজরতের মধ্যে জেহাদ অতি উত্তম আমল। আর তুমি কখনও আমীর(নেতা) হইও না। তারপর বলিলেন, এই আমীর(নেতা) হওয়া যাহাকে আজকাল তুমি শীতল ও সুস্বাদু দেখিতে পাইতেছ, অতিসত্বর তাহা এই পরিমাণ প্রসার ও অধিক হইবে যে, অযোগ্য ব্যক্তিও আমীরী(নেতা) লাভ করিবে। (স্মরণ রাখিও) যে কেহ আমীর(নেতা) হইবে তাহার হিসাব অন্য লোকদের তুলনায় দীর্ঘ হইবে এবং তাহার আযাব সর্বাপেক্ষা কঠিন হইবে। আর যে আমীর(নেতা) হইবে না, তাহার হিসাব অন্যদের তুলনায় অতি সহজ হইবে এবং তাহার আযাব সর্বাপেক্ষা হালকা হইবে। কেননা আমীররা(নেতারা) লোকদের উপর জুলুম করার সর্বাপেক্ষা বেশী সুযোগ পায়। আর যে ব্যক্তি মুসলমানের উপর জুলুম করে সে আল্লাহ তায়ালার অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে। কেননা মুসলমান আল্লাহ তায়ালার প্রতিবেশী এবং আল্লাহ তায়ালার বান্দা। আল্লাহর কসম, তোমাদের কাহারো প্রতিবেশীর বকরী বা উটের উপর কোন বিপদ আসিলে (অর্থাৎ প্রতিবেশীর বকরী বা উট চুরি হইয়া গেলে বা উটকে কেহ মারিলে বা কষ্ট দিলে প্রতিবেশীর পক্ষ হইয়া) রাত্রভর ক্রোধে তাহার পেশী ফুলিয়া থাকে। সে বলিতে থাকে, আমার প্রতিবেশীর বকরী বা উটের উপর এই বিপদ আসিয়াছে। (অতএব মানুষ যদি তাহার প্রতিবেশীর কারণে ক্রোধান্বিত হইতে পারে) তবে আল্লাহ তায়ালা তো তাহার প্রতিবেশীর কারণে ক্রোধান্বিত হওয়ার আরো বেশী হক রাখেন।
আরও পড়ুন: কোরআনে বর্ণিত দোয়া
রেফারেন্স: হায়াতুস সাহাবাহ (২য় খন্ড)